আবাসিক ইমারত বা বাড়ি

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় আবাসিক ইমারত বা বাড়ি । এই পাঠটি বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের, এসএসসি পর্যায়ের, ভোকেশনাল ডিসিপ্লিনের “আর্কিটেকচার ড্রাফট উইথ ক্যাড ১” বিষয়ের একটি পাঠ।

আবাসিক ইমারত বা বাড়ি

আবাসিক ইমারত বা বাড়ি

মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম প্রধান অংশ বাসস্থান। সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে নিরাপত্তার পাশাপাশি আরাম ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার চাহিদা অনুভব করে । এসব সার্বিক প্রয়োজন মিটাতে মানুষ গড়ে তোলে তার নিজস্ব আবাস। কাজেই আবাসিক ইমারত শুধু মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ই নয় এটি আরাম, প্রতিপত্তি ও যে কোনো পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতা থেকে রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করে।

আবাসিক ইমারতের বা বাড়ির সংজ্ঞা

মানুষ নিরাপত্তা, আরামদায়ক, পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতা, দৈনন্দিন সুযোগ-সুবিধা ও প্রতিপত্তি প্রভৃতি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে দীর্ঘ সময়ের জন্য যে ভবনে বা ইমারতে বসবাস করে তাকে বাড়ি বা আবাসিক ইমারত ‘বলে।

ইমারতটি আবাসিকে বসবাসকারীর নিজস্ব মালিকানাধীন হতে পারে আবার নাও হতে পারে কিন্তু সার্ভিস সুবিধাদি যেমন- রান্না, খাওয়া অর্থাৎ গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি নিজস্ব ক্ষমতাধীন থাকে । হোটেল বা ডরমিটরি ইত্যাদিতে মানুষ স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে দীর্ঘ সময়ের জন্য বসবাস করলেও এসব সুবিধাদি নিজস্ব আওতাধীন থাকে না।

যে সকল সুবিধাদি মানুষ একটি বাড়ি বা আবাসিক ইমারত থেকে পেয়ে থাকে তা নিম্নরূপ —

  • আশ্রয় (Shelter)
  • নিরাপত্তা (Security)
  • পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতা ( Social Adversity) থেকে সুরক্ষা
  • প্রাকৃতিক দুর্যোগ (Natural Hazards) থেকে রক্ষা
  • সার্ভিস সুবিধাদি (Services ie water, gas, electricity, sewerage etc.)
  • আরামদায়ক (Comfortable )
  • সামাজিক মর্যাদা (Social Status)।
  • বিশ্রামস্থল ( Rest Area)
  • আনুষাঙ্গিক চাহিদা (Convinence) পূরণ
  • বিলাসিতা ( Luxuries), স্বাচ্ছন্দ্য (Relief), রুচি (Elegance) ইত্যাদির প্রকাশ
  • সামাজিক ও পারিবারিক মিলনস্থল (Social & Family place or Rendezvous )
  • পারিবারিক সম্পর্ক (Family Relationship)।
  • বন্ধুত্ব ও সাহচর্য্য (Companionship
  • পারিবারিক চিত্তবিনোদন (Family Recreation)
  • শিশুদের খেলাধুলা (Games area )
  • প্রার্থনা ( Pray)

আবাসিক ইমারতের বা বাড়ির শ্রেণিবিভাগ

পরিবারের গঠন, ভবনের আকার আকৃতি ব্যবহার ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে আবাসিক ইমারত বা বাড়িকে (House) নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়—

  • ভিটাচড হাউস বা স্বতন্ত্র বাড়ি (Detached House),
  • সেমি-ডিটাচড হাউস বা আংশিক স্বতন্ত্র বাড়ি (Semi Detached House),
  • ডুপ্লেক্স হাউস বা প্রতিরূপ দ্বিতল স্বতন্ত্র বাড়ি (Duplex House
  • স্প্লিট লেভেল হাউস বা বন্ধুর বা অসমতল বাড়ি (Split Lovel House
  • রো-হাউস (Row House
  • এপার্টমেন্ট (Apartment House)

‘ডিটাড হাউস বা স্বতন্ত্র বাড়ি (Detached House):

একটি পরিবার এককভাবে একটি ভবনে বাস করলে তাকে ডিটাচ্‌ড হাউস বলে। সাধারণত এক তলা বিশিষ্ট হয়।

 

আবাসিক ইমারত বা বাড়ি

চিত্র ১.১.২.১: ডিটাচ্‌ড হাউস বা স্বতন্ত্র বাড়ি

সেমি-ডিটাচক হাউস বা আংশিক স্বতন্ন বাড়ি (Semi – Detached House): একক বা যৌথ মালিকানায় একাধিক পরিবার যখন একটি ভবনে বাস করে এবং কিছু সার্ভিস সকলে একত্রে ব্যবহার করে (যেমন-সিড়ি) তাকে সেমি ডিটাচড হাউস বলে। সাধারণত একাধিক বা একতলা হতে পারে।

 

আবাসিক ইমারত বা বাড়ি

চিত্র ১.১.২.২: সেমি ভিটাচড হাউস বা আংশিক স্বতন্ত্র ৰাড়ি

লোড বিয়ারিং ওয়াল ও ফ্রেম স্ট্রাকচার বিল্ডিং (Load Bearing wall & Framed Structured Building)

একটি মেঝের চারপাশে দেয়াল উপরে ছাদ দিয়ে আবৃত করলে একটি কক্ষ তৈরি হয়। দেয়ালসমূহ মাটির উপরে দাঁড় করানোর জন্য দেয়ালকে মাটির নিচে কিছুদূর পর্যন্ত প্রবেশ করিয়ে তৈরি করা হয়। কিংবা চারকোণায় স্তম্ভ বা কলাম এর উপর চারটি অনুভূমিক বিম দিয়ে খাঁচা তৈরি করে তার চারপাশে ও উপরে আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। এ রকম দুইটি পদ্ধতিতে ইমারত বা যে কোনো কাঠামো নির্মাণ করা হয় ।

লোড বিয়ারিং ওয়াল বিল্ডিং বা ভারবাহী দেয়াল ইমারত (Load Bearing Wall Building)

যখন কোনো কাঠামোর লোড বা ওজন দেয়ালের মাধ্যমে মাটিতে বহন করা হয় তাকে লোড বিয়ারিং ওয়াল বা ভারবাহী দেয়াল বলে। এক্ষেত্রে দেয়ালসমূহকে মাটির নিচের কিছুদূর পর ফুটিং-এ ক্রমশ ধাপে ধাপে বর্ধিত করে লোড বিস্তৃত এলাকায় ছড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। এরূপ যে সকল বিল্ডিং-এর দেয়ালসমূহ মাটির উপর সকল কাঠামোর এবং কাঠামোর উপর আরোপিত সকল প্রকার লোড বহন করে বলে একে লোড বিয়ারিং ওয়াল বিল্ডিং বলে।

যে সকল দেয়াল নিজস্ব ওজন ব্যতীত অন্য কাঠামোর ওজন বহন করে না তাকে নন লোড বিয়ারিং ওয়াল (Non-Load Bearing Wall Bullding) বা পার্টিশন ওয়াল বলে। সাধারণত: কক্ষসমূহকে বিভক্ত করার জন্য, পর্দা বা Screen, প্যানেল ওয়াল ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা হয়।

ফ্রেম স্ট্রাকচার বিল্ডিং (Frame Structure Building)

ফ্রেম স্ট্রাকচারে কক্ষের চারকোনায় স্তম্ভ বা কলাম-এর উপর চারটি অনুভূমিক বিম দিয়ে খাঁচা তৈরি করে তার চারপাশে ও উপরে আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। যে সকল ইমারতের বা কাঠামোর নিজস্ব ও উপরস্থ সকল লোড বিম থেকে কলাম হয়ে মাটির নিচে ছড়ানো হয় অর্থাৎ কাঠামোর সকল লোড কলাম বিমের তৈরি ফ্রেমের মাধ্যমে মাটির নিচে ছড়িয়ে দেয়া হয় তাকে ফ্রেম স্ট্রাকচার বিল্ডিং বলে।

এ ধরনের বিল্ডিং এ দেয়াল শুধু পার্টিশনের কাজ করে কোনো লোড বা বহন করে না। ফ্রেম স্ট্রাকচার মূলত আরসিসি দিয়ে তৈরি করা হয় ফলে লোড বিয়ারিং ওয়াল অপেক্ষা বেশি শক্তিশালী হয়।

ভেন্টিলেশন

বাড়ির বাসিন্দাদের দৈনন্দিন কাজ কর্মে, রান্নায়, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে, ঘরের ভিতরের বাতাস ক্রমশ উত্তপ্ত ও দূষিত হতে থাকে । এই উত্তপ্ত ও দূষিত বাতাস দূর করে কক্ষের বাতাসকে নিঃশ্বাস উপযোগী ও আরামদায়ক করার প্রয়োজন হয়। যে পদ্ধতিতে কক্ষের উত্তপ্ত ও দূষিত বাতাস দূর করে বাইরের নির্মল বাতাস সরবরাহ করে কক্ষের বাতাসকে বিশুদ্ধ, নিঃশ্বাস উপযোগী ও আরামদায়ক করা হয় তাকে ভেন্টিলেশন বলে।

নিম্নলিখিত কারণে একটি ভবনে ভেন্টিলেশন করা হয়:

  • বাড়ির বাসিন্দাদের নির্মল, বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন বাতাস সরবরাহ করার জন্য,
  • বায়ু চলাচল স্বাভাবিক রাখতে,
  • CO2 অযথা পুঞ্জিভূত হওয়াকে প্রতিরোধ করতে,
  • বাতাসে O2 ঘাটতি পূরণের জন্য,
  • বিল্ডিং ম্যটেরিয়ালস-এর পচনের ফলে সৃষ্ট দুর্গন্ধ থেকে রক্ষা করার জন্য,
  • কক্ষের ভিতরের বাতাসকে ঘামের দুর্গন্ধ মুক্ত করার জন্য,
  • বাতাসে অবস্থিত ধুলিকণা, ধোয়া, গ্যাস যা বাসিন্দাদের বা কক্ষে অবস্থানকারীদের ক্ষতি করে তা অপসারণ করার জন্য,
  • কক্ষে তাপমাত্রা ও পরিবেশ অবস্থানকারীদের জন্য আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যসম্মত করার জন্য,
  • বাতাসে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি একটি নির্দিষ্ট বা সহনীয় মাত্রায় রাখা, এবং
  • বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ একটি নির্দিষ্ট বা সহনীয় মাত্রায় রাখা।

ভেন্টিলেশন প্রধানত দুই প্রকার

  • প্রাকৃতিক ভেন্টিলেশন বা Natural Ventilation
  • যান্ত্রিক ভেন্টিলেশন বা Mechanical Ventilation

বাইরের নির্মল বাতাস যখন প্রাকৃতিক উপায়ে একদিকের দরজা-জানালা বা এরূপ ওপেনিং দিয়ে প্রবেশ করে দূষিত বাতাসকে অন্য দিক দিয়ে বের করে দেয় তাকে প্রাকৃতিক ভেন্টিলেশন বলে। এজন্য কমপক্ষে রুমের ক্ষেত্রফলের ১/২০ ভাগ ওপেনিং রাখার প্রয়োজন হয়। সাধারণত দরজা, জানালা, যে কোনো ফাঁকা বা ওপেনিং, ভেন্টিলেটর ইত্যাদির সাহায্যে করা হয়ে থাকে। বাতাস প্রবেশের দিককে ইনলেট ও বের হওয়ার দিককে আউটলেট বলে।

কক্ষের ভিতরের বাতাসকে যখন যান্ত্রিক উপায়ে অপসারণ করে নির্মল বাতাস পুনঃস্থাপন করা হয় তাকে যান্ত্রিক ভেন্টিলেশন বলে। সাধারণত যে কোন যন্ত্র যেমন- বৈদ্যুতিক পাখা বা ফ্যান, এগজস্ট ফ্যান, এসি ইত্যাদির সাহায্যে করা হয়ে থাকে। বাইরের নির্মল বাতাস যখন একদিকের দরজা জানালা বা ওপেনিং দিয়ে প্রবেশ করে দূষিত বাতাসকে বিপরীত দিকের দেয়ালে অবস্থিত দরজা জানালা বা ওপেনিং দিয়ে বের করে দেয় তাকে ক্রস-ভেন্টিলেশন (Cross Ventilation) বলে।

আবাসিক ইমারতের বিভিন্ন কক্ষে ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা

আমাদের দেশের জলবায়ু এবং বাতাসের দিক অনুযায়ী আবাসিক ইমারতের বিভিন্ন কক্ষে ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা নিম্নরূপ হলে ভালো হয় –

শয়ন কক্ষ: অবশ্যই ক্রস ভেন্টিলেশন হতে হবে। এক্ষেত্রে বিপরীত দিকের দেয়ালে সম্ভব না হলেও কোণাকুণি বা পার্শ্ব দেয়ালে জানালা বা ওপেনিং রাখতে হবে।

বসার ঘর: সম্ভব হলে ক্রস ভেন্টিলেশন অথবা অন্তত এক পাশের বাইরের দেয়ালে জানালা থাকতে হবে। খাবার ঘর: অন্তত এক পাশের বাইরের দেয়ালে জানালা থাকতে হবে। তবে ক্রস ভেন্টিলেশন থাকলে ভালো হয়।

পারিবারিক কক্ষ: সম্ভব হলে ক্রস ভেন্টলেশন অথবা অন্তত এক পাশের বাইরের দেয়ালে জানালা থাকতে হবে। অতিথি কক্ষ: এটিও বেড বা শয়ন কক্ষ বিধায় অন্যান্য শয়ন কক্ষের মত ক্রস ভেন্টিলেশন রাখতে হবে। টয়লেট/ বাথ: অন্তত এক পাশের বাইরের দেয়ালে ছোটো হলেও জানালা অবশ্যই থাকতে হবে।

সিঁড়ি: আরামদায়ক উঠানামার জন্য মেঝে থেকে মেঝে পর্যন্ত অর্থাৎ যত বড় সম্ভব জানালা থাকলে ভালো হয় । রান্না ঘর, কিচেন স্টোর: উত্তম ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়, এজন্য যতদূর সম্ভব পূর্বদিকের বাইরের দেয়ালে (যদি থাকে) বা অন্তত একটি দিকে বাইরের দেয়ালে জানালা অবশ্যই থাকতে হবে। ভিতরের গ্যাস দ্রুত অপসারণের জন্য যান্ত্রিক পদ্ধতি (Exhust Fan) প্রয়োগ করা যেতে পারে ।

স্টোর, লন্ড্রি, ইউটিলিটি ইত্যাদি অন্তত এক পাশের বাইরের দেয়ালে জানালা থাকতে হবে। খেলাধুলা, চিত্তবিনাদেনের, সংগীত কক্ষ, স্টাডি,লাইব্রেরি, প্রার্থনা: ক্রস ভেন্টিলেশন থাকলে ভালো হয়। সম্ভব না হলে অন্তত এক পাশের বাইরের দেয়ালে বড় জানালা (যত বড় সম্ভব) ব্যবহার করতে হবে।

 

সার্ভেয়িং ১ সূচিপত্র

গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

প্রশ্নমালা

অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন

১. আবাসিক ইমারত কাকে বলে?

২. আবাসিক ইমারত বা বাড়ি কত প্রকার ও কী কী? ৩. ইমারত বা কাঠামো কি কি পদ্ধতিতে নির্মাণ করা হয়?

৪. আবাসিক ইমারতের বেসিক এরিয়া কয়টি ও কী কী?

৫. ভেন্টিলেশন কত প্রকার ও কী কী?

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন

১. ভারবাহী দেয়াল নির্মিত ইমারত ও ফ্রেম স্ট্রাকচার ইমারত বলতে কী বোঝ, ব্যাখ্যা কর।

২. আবাসিক ইমারতের বেসিক এরিয়ার প্রধান প্রধান কক্ষসমূহের নাম লিখ ।

৩. ইমারতে ভেন্টিলেশনের কারণ বর্ণনা কর।

৪. প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম ভেন্টিলেশনের পার্থক্য বর্ণনা কর ।

রচনামূলক প্রশ্ন

১. আবাসিক ইমারত বা বাড়ি থেকে মানুষ কি কি সুবিধাদি পেয়ে থাকে তার বিস্তারিত বর্ণনা দাও।

২. আবাসিক ইমারত বা বাড়ির শ্রেণিবিভাগ বিস্তারিত বর্ণনা কর ।

৩. লোড বিয়ারিং ওয়াল বিল্ডিং ও ফ্রেম স্ট্রাকচার বিল্ডিং-এর চিত্রসহ পার্থক্য বর্ণনা কর ।

৪. আবাসিক ইমারতের বেসিক এরিয়ার প্রধান প্রধান কক্ষসমূহের মাপ ও কাজ লেখ।

৫. আবাসিক ইমারতের প্রধান প্রধান কক্ষসমূহের ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা বর্ণনা কর ।

Leave a Comment