আর্কিটেকচার পড়ার যোগ্যতা

আর্কিটেকচার বা স্থাপত্যবিদ্যা শুধুমাত্র একটি পেশাগত বিষয় নয়—এটি শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক সমন্বিত ক্ষেত্র। এই বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট কিছু যোগ্যতা ও প্রস্তুতি থাকা জরুরি। বাংলাদেশে আর্কিটেকচার পড়ার সুযোগ সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে, যেখানে সম্মান (Bachelor in Architecture) ডিগ্রি থেকে শুরু করে মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ আছে।

ইমারত সংক্রান্ত ড্রয়িং

 

Table of Contents

আর্কিটেকচার পড়ার যোগ্যতা:

১. শিক্ষাগত যোগ্যতা

  • এসএসসি এইচএসসি (বিজ্ঞান বিভাগ): আর্কিটেকচার অধ্যয়নের জন্য শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
  • বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজনীয়তা: পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিত বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে থাকতে হবে এবং ভালো ফলাফল (সাধারণত ন্যূনতম জিপিএ ৪.০) প্রয়োজন।
  • সমমানের যোগ্যতা: ‘A Level’ বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক শিক্ষা পদ্ধতির শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ সমমান নির্ধারণ করে।

২. ভর্তি পরীক্ষা

  • লিখিত পরীক্ষা: বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান ও বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন নিয়ে লিখিত পরীক্ষা নেয়।
  • মুক্তহস্ত অঙ্কন পরীক্ষা: স্থাপত্যবিদ্যার জন্য ড্রইং দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রার্থীদের মুক্তহস্ত অঙ্কন বা স্কেচিং পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়, যেখানে সৃজনশীলতা, দৃষ্টিনন্দন নকশা তৈরি ও অনুপাতের ধারণা যাচাই করা হয়।
  • মৌখিক পরীক্ষা (Interview): কিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের নকশাগত ধারণা, সৃজনশীল চিন্তাশক্তি ও যোগাযোগ দক্ষতা যাচাই করে।

৩. প্রয়োজনীয় দক্ষতা

  • ড্রইং ভিজ্যুয়ালাইজেশন স্কিল: স্থাপত্যবিদ্যা সরাসরি নকশা ও অঙ্কনের উপর নির্ভরশীল। তাই হাতে আঁকার দক্ষতা, রঙের ব্যবহার এবং কম্পিউটার ভিত্তিক ডিজাইন সফটওয়্যারের (যেমন AutoCAD, SketchUp, Revit) উপর দক্ষতা থাকা সহায়ক।
  • সৃজনশীলতা: অনন্য নকশা তৈরি করার ক্ষমতা ও নান্দনিকতার বোধ অপরিহার্য।
  • সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি: নকশার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর সৃজনশীল সমাধান দেওয়ার দক্ষতা থাকতে হবে।
  • গাণিতিক দক্ষতা: আর্কিটেকচারাল স্ট্রাকচার, অনুপাত, স্কেল, লোড ক্যালকুলেশন ইত্যাদি নির্ধারণে গণিতের জ্ঞান অপরিহার্য।
  • যোগাযোগ উপস্থাপনা দক্ষতা: স্থাপত্যবিদ্যায় প্রজেক্ট ক্লায়েন্ট, সহকর্মী ও শিক্ষকের সামনে উপস্থাপন করতে হয়, তাই কার্যকর যোগাযোগ দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ।

৪. অধ্যয়নের সুযোগ

বাংলাদেশে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকসহ অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিটেকচার বিষয়ে পড়াশোনা করা যায়।

৫. ভবিষ্যৎ সুযোগ

আর্কিটেকচারে স্নাতক সম্পন্ন করার পর—

  • পেশাগত স্থপতি হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ
  • সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্থাপত্য ও নকশা সংশ্লিষ্ট কাজ
  • নগর পরিকল্পনা, ইন্টেরিয়র ডিজাইন, ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচারসহ বিশেষায়িত ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ
  • মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে গবেষণা ও শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রাখার সুযোগ

 

বহুতল ইমারজে ইলেকট্রিক্যাল ড্রয়িং

 

বাংলাদেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্কিটেকচার ভর্তি প্রক্রিয়া ও জিপিএ চাহিদা একটি টেবিল:

বিশ্ববিদ্যালয়ের নামভর্তি প্রক্রিয়া ধাপজিপিএ চাহিদা (এসএসসি + এইচএসসি)
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (BUET)বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হতে হবে, ইউনিভার্সিটির নিজস্ব ভর্তি পরীক্ষা (গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, মুক্তহস্ত অঙ্কন)উভয় পরীক্ষায় ন্যূনতম GPA 4.50, মোট GPA ≥ 9.00
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (CUET)বিজ্ঞান বিভাগ, ভর্তি পরীক্ষা (গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, ইংরেজি, মুক্তহস্ত অঙ্কন)উভয় পরীক্ষায় ন্যূনতম GPA 4.50, মোট GPA ≥ 9.00
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (RUET)বিজ্ঞান বিভাগ, ভর্তি পরীক্ষা (গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, মুক্তহস্ত অঙ্কন)উভয় পরীক্ষায় ন্যূনতম GPA 4.00, মোট GPA ≥ 8.00
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (KUET)বিজ্ঞান বিভাগ, ভর্তি পরীক্ষা (গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, মুক্তহস্ত অঙ্কন)উভয় পরীক্ষায় ন্যূনতম GPA 4.00, মোট GPA ≥ 8.00
আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (AUST)বিজ্ঞান বিভাগ, ভর্তি পরীক্ষা / মেধা তালিকা অনুযায়ী নির্বাচনউভয় পরীক্ষায় ন্যূনতম GPA 4.00, মোট GPA ≥ 8.00
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় (NSU)বিজ্ঞান বিভাগ, ভর্তি পরীক্ষা / সাক্ষাৎকারউভয় পরীক্ষায় ন্যূনতম GPA 3.50, মোট GPA ≥ 7.50
বিআরএসি বিশ্ববিদ্যালয় (BRAC)বিজ্ঞান বিভাগ, ভর্তি পরীক্ষা / সাক্ষাৎকারউভয় পরীক্ষায় ন্যূনতম GPA 3.50, মোট GPA ≥ 7.50
ইন্ডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ (IUB)বিজ্ঞান বিভাগ, ভর্তি পরীক্ষা / সাক্ষাৎকারউভয় পরীক্ষায় ন্যূনতম GPA 3.50, মোট GPA ≥ 7.00

 

আর্কিটেকচার পড়ার যোগ্যতা

 

আর্কিটেকচার যারা পড়ায় সেসব বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সাধারণ তথ্য:

খুলনা প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (Khulna University of Engineering & Technology – KUET):

KUET-এ আর্কিটেকচার অধ্যয়নের জন্য প্রার্থীকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উচ্চতর গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে ন্যূনতম GPA ৩.৫০ এবং ইংরেজিতে GPA ৩.০০ অর্জন করতে হবে। এখানে আর্কিটেকচার বিভাগে মোট আসন সংখ্যা মাত্র ৩৫, যা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ মেধাতালিকা ভিত্তিক, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীরাই সুযোগ পায়।

 

চট্টগ্রাম প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (Chittagong University of Engineering & Technology – CUET):

CUET-এর আর্কিটেকচার বিভাগে ভর্তি হতে হলে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উভয় পরীক্ষায় (ঐচ্ছিক বাদে) ন্যূনতম GPA ৪.০০ থাকতে হবে। এই বিভাগে আসন সংখ্যা মাত্র ৩০, ফলে প্রতিযোগিতা বেশ তীব্র। ভর্তি প্রক্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ভর্তি পরীক্ষা ও মেধাতালিকার উপর নির্ভরশীল, যেখানে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, এবং মুক্তহস্ত অঙ্কন বিশেষ গুরুত্ব পায়।

 

শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (Shahjalal University of Science and Technology – SUST):

SUST-এর আর্কিটেকচার বিভাগ সৃজনশীলতা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান সমন্বিত শিক্ষা প্রদান করে। ভর্তি হতে হলে প্রার্থীকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উভয় পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। বিভাগটি হাতে-কলমে প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা, নকশা প্রণয়ন, এবং নগর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে।

 

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় (North South University – NSU):

NSU-এর আর্কিটেকচার বিভাগ আন্তর্জাতিক মানের কারিকুলাম অনুসারে পরিচালিত হয়, যেখানে নকশা, স্থাপত্য ইতিহাস, টেকসই ডিজাইন এবং আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভর্তি হতে হলে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উভয় পরীক্ষায় ভালো ফলাফল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যক।

 

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় (BRAC University):

BRAC University-এর আর্কিটেকচার প্রোগ্রাম বাংলাদেশে অন্যতম সৃজনশীল ও আধুনিক, যেখানে শিক্ষার্থীরা নগর পরিকল্পনা, পরিবেশবান্ধব নকশা এবং উদ্ভাবনী স্থাপত্য সমাধান নিয়ে কাজ করে। ভর্তি প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ফলাফল, সৃজনশীল দক্ষতা, এবং সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে যোগ্যতা যাচাই করা হয়।

 

আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (Ahsanullah University of Science and Technology – AUST):

AUST-এর আর্কিটেকচার বিভাগ শিল্প ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে নকশা ও পরিকল্পনা শিক্ষা দেয়। ভর্তি হতে হলে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উভয় পরীক্ষায় ভালো ফলাফল থাকতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ও/অথবা মেধাতালিকায় নির্বাচিত হতে হবে।

 

ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (University of Asia Pacific – UAP):

UAP-এর আর্কিটেকচার প্রোগ্রাম দেশে ও বিদেশে স্বীকৃত, যেখানে স্থাপত্য নকশা, নগর উন্নয়ন এবং সংরক্ষণ প্রকল্পে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ভর্তি প্রক্রিয়ায় একাডেমিক যোগ্যতার পাশাপাশি সৃজনশীলতা ও নকশা দক্ষতা মূল্যায়ন করা হয়।

 

ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (Independent University, Bangladesh – IUB):

IUB-এর আর্কিটেকচার বিভাগ আধুনিক প্রযুক্তি ও সৃজনশীল নকশার উপর গুরুত্ব দেয়, যেখানে শিক্ষার্থীরা বহুমাত্রিক স্থাপত্য সমাধান তৈরি করে। ভর্তি প্রক্রিয়া একাডেমিক ফলাফল, ভর্তি পরীক্ষা ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

 

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (Daffodil International University – DIU):

DIU-এর আর্কিটেকচার বিভাগ শিক্ষার্থীদেরকে নকশা, বিল্ডিং টেকনোলজি, নগর পরিকল্পনা ও পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যে দক্ষ করে তোলে। ভর্তি হতে হলে একাডেমিক যোগ্যতার পাশাপাশি সৃজনশীলতার প্রমাণ প্রদর্শন করতে হয়, যা ভর্তি পরীক্ষা বা সাক্ষাৎকারে মূল্যায়ন করা হয়।

Leave a Comment